১৮০টি দেশে প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটুকু তা জরিপ করে দেখা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা ১৪৬ নম্বরে। নরওয়ে, সুইডেন, হল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইত্জারল্যান্ড, এসব দেশ ১, ২, ৩, ৪, ৫ নম্বর স্থানে, প্রথম দিকে। সবচেয়ে তলানিতে আছে উত্তর কোরিয়া, এরিত্রিয়া, তুর্কমেনিস্তান, সিরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, সুদান। এই জরিপটি করেছে রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স। খুব নামি সংস্থা। সন্দিগ্ধ হওয়ার বড় কারণ নেই।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা জিনিসটা কি? জিনিসটা হলো, যে কোনও সময়ে যে কোনও বিষয়ে যে কোনও মানুষের যে কোনও মত সরকারি কোনও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করার অধিকার। এই মত যে কোনও কিছুর বিরুদ্ধে যেতে পারে, সরকার, রাষ্ট্র, ধর্ম, আইন, সমাজ, সংস্কৃতি, ব্যক্তি, ইত্যাদি। কিন্তু এ নিয়ে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিককে কোনও রকম দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকা মানে রেডিও টেলিভিশনেরও স্বাধীনতা থাকা। গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হলো প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং প্রতিটি মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কোন দেশে গণতন্ত্র কী অবস্থায় আছে, তা ব্যক্তির মত প্রকাশের অধিকার বা প্রচারমাধ্যমের অধিকারের দিকে তাকালেই অনুমান করা যায়।
প্রেস ফ্রিডমের ইন্ডেক্সে ভারতের র্যাংক ১৩৮। পাকিস্তানের ১৩৯। নেপালের ১০৬। শ্রীলঙ্কার ১৩১। বার্মার ১৩৭। আফগানিস্তানের ১১৮। ভুটানের ৯৪। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। প্রচুর মুসলিম দেশও এগিয়ে আছে বাংলাদেশের চেয়ে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, কাতার, কুয়েত, মালি সবাই বাংলাদেশের চেয়ে ওপরে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছে রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স, তা হলো বাংলাদেশে ধর্ম সম্পর্কে ভিন্ন মত প্রকাশ করা যায় না, সরকারের সমালোচনা করা যায় না। জেলে যেতে হয়, অথবা মৃত্যুদণ্ড পেতে হয়। সাংবাদিকদের ওপর সরকারি নির্যাতন হতে পারে এই ভয়ে, অথবা সংবাদপত্র বন্ধ করে দিতে পারে সরকার—এই ভয়ে সাংবাদিকরা নিজেদের লেখা নিজেরাই সেন্সর করেন। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় প্রচুর সাংবাদিক, ব্লগার, আর ফেসবুকারদের ফাঁসানো হয়েছে গত বছর। বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এই কালো আইনটি বাতিল করবেন, তা নয়, বাংলাদেশ সরকার এ বছর নতুন ডিজিটাল সিকুইরিটি আইন আনার পরিকল্পনা করেছেন। সুতরাং সকলের মুখ বন্ধ রাখতে হবে। তা না হলে সর্বনাশ।
এসব দেশে, গণতন্ত্র মানে, বেশির ভাগ লোকই বিশ্বাস করে, ভোটের নির্বাচন, নির্বাচনে কেউ জিতবে, কেউ হারবে, যে জিতবে সে দেশ শাসন করবে। কিন্তু গণতন্ত্র এর চেয়েও বেশি কিছু। গণতান্ত্রিক অধিকার মানে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপদে বাঁচার অধিকার, সুশিক্ষা সুস্বাস্থ্য পাওয়ার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, সে মত যত ভিন্নই হোক না কেন। সত্য হলো, আমাদের গণতন্ত্র আছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। এ অনেকটা আমাদের খাদ্য আছে, কিন্তু খাদ্য ভক্ষণ করার অধিকার আমাদের নেই। এমন পঙ্গু গণতন্ত্র নিয়ে আমরা বাস করছি দীর্ঘ দীর্ঘকাল। স্বৈরাচারী সরকারের সংগে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের খুব একটা তফাত দেখতে পাই না।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, আমার পাঠকপ্রিয়তা আছে বলে সংবাদপত্রের সম্পাদকগণ আমার লেখা প্রকাশ করায় আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ভয়ও পেতেন, আমার লেখা ছাপালে ধর্মান্ধ আর নারীবিদ্বেষীরা কী না কী উৎপাত শুরু করে! পাঠকপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও আমার লেখা হয় সেন্সর করে ছাপিয়েছেন, নয়তো লেখা ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছেন সম্পাদকগণ। এর কারণ ভয়, ভয় পান সরকারকে, ভয় পান কট্টরপন্থীদের। দেশে আতঙ্কবাদির সংখ্যা যেমন বাড়ছে, আপসকামীর সংখ্যাও তেমন বাড়ছে। একটি সত্যি আমাকে বড় বিস্মিত এবং বেদনাগ্রস্ত করে। সংবাদপত্রে যে সব সমালোচনা আশির দশকে ছাপানো সম্ভব ছিল, তা আজ সম্ভব নয়। মত প্রকাশের যে অধিকার আমার ছিল এমনকী নব্বই দশকের শুরুতে, তার অর্ধেকও এখন নেই। এর মানে কি এই নয় যে দিন দিন মানুষের বাক স্বাধীনতা কমছে? দিন দিন মানুষ তার গণতান্ত্রিক অধিকার হারাচ্ছে? ১৯৪৫ সালে রচিত জাতিসংঘের ‘মানবাধিকার সনদ’ বলছে, প্রত্যেকের কথা বলার অধিকার আছে, এবং প্রত্যেকের অধিকার আছে তথ্য জানার, তথ্য প্রকাশ করার, মত জানার, এবং মত প্রকাশ করার। এবং অধিকার আছে দেশ এবং দেশের বাইরে যে কোনও পত্র পত্রিকায় নিজের মতাদর্শ প্রচার করার। মানবাধিকারের জন্য চিরকালই চিৎকার করেন খুব অল্প সংখ্যক মানুষ। সরকার তাই ভ্রুক্ষেপ করেন না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মানবাধিকারের জন্য আন্দোলন করার বদলে ভয়ে কুঁকড়ে থাকা নয়তো আপস করাই বেছে নেয়।
গত বছর ২৬২ জন সাংবাদিককে জেলে পোরা হয়েছে। তুরস্ক, চীন, মিশরের সাংবাদিকই দলে ভারী। গণতন্ত্র নেই, অথবা গণতন্ত্র নড়বড়ে—এমন সব দেশে প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা শাসকের জন্য ভয়ঙ্কর রকম আতঙ্কের ব্যাপার। তাই অগণতান্ত্রিক দেশগুলো নিজেদের লোক দিয়ে প্রচারমাধ্যম চালায়। যেমন চীন। চীনের সব পত্র পত্রিকা রেডিও টেলিভিশন চীনের সরকারের অধীন। সবাই চীনের সরকারের গুণকীর্তন করে। বিরোধী দলও যেমন নেই, বিরোধী কণ্ঠস্বরও নেই। নেই মানে থাকার অধিকার নেই। থাকার অধিকার চাইলে ট্যাঙ্ক এনে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে সবার বুক। ইতিহাস তো এমনই বলে।
কিছু কিছু অঞ্চলে বিদেশি সাংবাদিকের প্রবেশ নিষেধ। সঠিক তথ্য পেতে দিতে রাজি নয় সরকার। এলাকাগুলো রাশিয়ার চেচনিয়া, ভারতের জম্মু কাশ্মীর, পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তান, নাইজেরের আগাদেজ, ইথিওপিয়ার অগাডেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য আর উত্তর কোরিয়া। এইসব এলাকায় সত্যিকারের কী ঘটনা ঘটছে, জানার কোনও উপায় নেই। এইসব এলাকার নির্ভুল তথ্য জানার অধিকার বিশ্বের মানুষের নেই। বিশ্বের মানুষ তাদের প্রাপ্য মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সরকারই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার সবচেয়ে বেশি ভয় পায় সাংবাদিকদের। সাংবাদিকরা দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করে দিলে সরকারের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু যে সব দেশের সরকার উন্নতি চাইছে দেশের, যেমন বাংলাদেশের সরকার, তাদের কেন ভয় মিডিয়াকে? সরকার যদি সামান্যও সমালোচনা সহ্য করতে না পারেন, তাহলে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখবেন কী করে? চারদিকে সবাই স্তাবক হলে নিজের ভুল ত্রুটি চোখে পড়বে না। আর তা না হলে নিজেদের ভুল ত্রুটি সংশোধন করাও সম্ভব হবে না। ক্রমাগত সংশোধন করতে হবে নিজেদের। তা না হলে আত্মম্ভরিতাই সর্বনাশ ডেকে আনবে।
ক্ষমতাসীনদের কার্টুন আঁকলে জেলবাস হবে, নারীর সমানাধিকার চাইতে গিয়ে ধর্মান্ধতার নিন্দে করলে নির্বাসনে যেতে হবে, ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন করলে খুন হয়ে যেতে হবে—এসবই চলছে বাংলাদেশে। প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা কমতে কমতে শেষ অবধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে।
আমাকে একবার বাংলাদেশের একটি পত্রিকার সম্পাদক তাঁর পত্রিকায় লেখার জন্য কিছু শর্ত দিয়েছিলেন। আমাদের কথোপকথন এমন ছিল।
আমি : … শর্ত? ইসলাম সম্পর্কে লেখা যাবে না। ঠিক না?
সম্পাদক : … ঠিক।
আমি : অন্য ধর্মের সমালোচনা করা যাবে তো?
সম্পাদক : যাবে।
আমি : মৌলবাদিদের সমালোচনা করা যাবে?
সম্পাদক : যাবে।
আমি : বেশ, তাহলে যাবে না কি?
সম্পাদক : শাসকদের কোনও সমালোচনা করা যাবে না।
আমি স্তম্ভিত বসে রইলাম। ধর্মান্ধরা দেশে তাণ্ডব চালায় ধর্মের সমালোচনা করলে। সরকার তাণ্ডব সামাল দিতে পারবে না এই অজুহাতে অনেক সময় ধর্মের গঠনমূলক সমালোচনাকেই নিষিদ্ধ করে দেয়। আইনও তো প্রচুর আছে ধর্মকে রক্ষা করার পক্ষে। কিন্তু সরকারের সমালোচনা করা যাবে না, সরকারের ভুল ত্রুটিগুলো তুলে ধরা চলবে না, ‘যা করেছো ভালো করেছো’ ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না, এ কেমন গণতন্ত্র বাংলাদেশে?
তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসহীনতা দেখা দেয় তখনই, যখনই স্তাবক ছাড়া আর কারও সঙ্গে চলাফেরা করতে সে পারে না। অনেকটা ঈশ্বরের মতো। ঈশ্বরের কোনও নিন্দে ঈশ্বর সইতে পারেন না। ঈশ্বর কোনও ভুল করতে পারেন না, তাই ভুল শোধরানোর কোনও ব্যাপার তাঁর নেই। ঈশ্বরের যে নিন্দে করবে তার নরকবাস হবে। আর দেশের শাসকের যে নিন্দে করবে তার জেলবাস হবে। জেল তো অনেকটা নরকের মতোই। ঈশ্বর আর দেশের শাসকের মধ্যে পার্থক্যটা হলো, ঈশ্বর অলৌকিক, আর শাসক লৌকিক। ঈশ্বর কল্পনা, শাসক বাস্তব। বাস্তবের মানুষদের কল্পনায় বাস করার চেয়ে বাস্তবে বাস করাই উচিত।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।